প্রতিষ্ঠিত নায়িকারা আছেন নায়িকা সংবাদ
কিছুদিন আগে মুক্তি পেয়েছিল কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবির নায়িকা মৌসুমীর নতুন ছবি দুলাভাই জিন্দাবাদ। মুক্তির আগে যতটা আলোচনায় ছিল এই ছবি, মুক্তির পর ততটাই নীরবে হিসাব-নিকাশ চুকে গেল। দুলাভাই জিন্দাবাদ এবং পাগল মানুষ যেন ‘অংশগ্রহণই বড় কথা’। প্রদর্শক, পরিবেশক—কেউই বললেন না ছবিগুলো ‘হিট’ হয়েছে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলেছে।
মনের মাঝে তুমি ছবির চিত্রনায়িকা পূর্ণিমার কত নাম-ডাক। বিজ্ঞাপন করছেন, উপস্থাপনা করে দেশে-বিদেশে প্রশংসা পাচ্ছেন। কুলি ছবির নায়িকা পপি ওজন কমিয়ে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন। কিন্তু সিনেমা হলে শেষ কবে তাঁদের নতুন ছবি দেখেছেন, তা হয়তো অনেক দর্শকই মনে করতে পারবেন না।
অথচ এই শাবনূর, মৌসুমী, পূর্ণিমা, পপির অভিনয়, নাচ, হাসি-কান্না দেখার জন্য দর্শকের ভিড় লেগে যেত সারা দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে। স্কুল পালিয়ে কিশোরেরা ছবি দেখতে যেত। শুক্রবারে দলবল নিয়ে পরিবারের নারী-পুরুষ যেতেন প্রেক্ষাগৃহে। রাতের প্রদর্শনী দেখে তরুণেরা গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরতেন, ‘ও সাথি রে যেও না কখনো দূরে...’।
নানা রকমের সংকটে বাংলা চলচ্চিত্র। এর মধ্যে একটি বড় সংকটের নাম ‘নায়িকা-সংকট’। নায়িকা-সংকট, নায়িকাকে নিয়ে সংকট, নায়িকাকে ঠিকভাবে উপস্থাপন করার সংকট। সংখ্যার বিবেচনায় নায়িকা নেই। হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন। নতুনও আসছেন কম। পুরোনো প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের যথাযথ উপস্থাপন নেই। সব নির্মাতা বা নির্মাণপ্রতিষ্ঠান চায় নির্ভরযোগ্য নায়ক-নায়িকা নিয়ে কাজ করতে, যাঁদের নাম শুনে দর্শক হলে আসবে। সমস্যা হচ্ছে, যাঁদের নাম শুনে দর্শক হলে আসে, তাঁদের নিয়েও নির্মাতাদের আছে নানা অভিযোগ।
আছি তবে নাই
এখন যে নায়িকাদের নিয়ে আলোচনা হয়, তাদের উত্তরণ নব্বইয়ে। নব্বইয়ের দশকে কেয়ামত থেকে কেয়ামত, চাঁদনি ছবি হিট হওয়ার পর ওই সময়ের প্রতিষ্ঠিত জ্যেষ্ঠ নায়িকাদের দাপটের পাশাপাশি নিজেদের অবস্থান জানান দিতে থাকেন শাবনাজ, মৌসুমী, শাবনূর, পূর্ণিমা, পপি প্রমুখ। চলচ্চিত্র সমালোচক অনুপম হায়াতের মতে, গোটা নব্বইয়ের দশকজুড়ে নতুন নায়িকাদের মিছিল ছিল। কোনো একক দশকে এত নায়িকার আগমন আর দেখা যায়নি। ডজন ডজন নায়িকা অনেক নামের ভিড়ে আজ কালের অন্তরালে আছেন মুখ লুকিয়ে। কেউ প্রবাসী হয়েছেন, কেউ সংসারী হয়েছেন।
পর্দায় নিজেকে নতুন করে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হন নায়িকারা। তাঁরা নায়িকাই হয়ে থাকতে চেয়েছেন কিংবা পরিচালকেরা তাঁদের নিয়ে ভাবেননি। এসব তারকাকে নিয়ে কাজ করেছেন এমন পাঁচজন পরিচালকের কাছে জানতে চাওয়া হয়, নতুন ছবি বানালে তাঁদের নায়িকা হিসেবে নেবেন কি না। নাম প্রকাশ না করার শর্ত দিয়ে সবাই একই মতামত দিয়েছেন—‘না’।
যেহেতু দীর্ঘদিনের বিরতি আছে, তাই এঁদের নিয়ে ছবি বানালে বাজার ধরা কঠিন হয়ে যাবে। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা মিঞা আলাউদ্দিন বলেন, এখন যেহেতু ডিজিটাল যুগ, মানুষের হাতেই নানা রকমের অপশন রয়েছে। এ কারণে মানুষের রুচি, চাহিদার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। পুরোনোটা গ্রহণ করছে না।
চরিত্রনির্ভর উপস্থিতি
চিত্রনায়িকা সুচিত্রা সেন, শেষ পর্যন্ত নায়িকা হিসেবেই থেকেছিলেন। একটা বয়সে নিজেকে গুটিয়ে তৈরি করেন চলচ্চিত্রের বাইরে নিজের একটা ভুবন। তিনি ব্যতিক্রম। ভারতের একসময়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা শ্রীদেবী দীর্ঘদিন পর আলোচনায় এসেছেন নতুন পরিচয়ে। মায়ের চরিত্রে তিনি সফল, যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রটিই তাঁর। অর্থাৎ, পরিচালক তাঁকে কেন্দ্র করে ছবি বানিয়েছেন, প্রযোজক অর্থ লগ্নি করেছেন।
কিন্তু আমাদের দেশের সমকালীন নায়িকারা ‘চরিত্রনির্ভর’ অভিনেত্রী হয়ে উঠতে পারেননি কিংবা পরিচালকেরা সেভাবে উপস্থাপনের উদ্যোগ নেননি। ববিতা, শাবানার মতো একসময়ের তুখোড় জনপ্রিয় তারকারা নিজেদের একটা সময়ে নায়িকার বাইরে অন্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন নিয়মিতভাবেই। মা, ভাবী, বিচারক—এমন সহশিল্পী চরিত্রে নিজেদের মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন।
কোথায় গেলেন গোলাপি
চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে ‘গোলাপি’ শব্দটা এলেই যে কারও মাথায় প্রথমে আসবে একটি ছবির নাম, গোলাপি এখন ট্রেনে। আর এই ছবির নামটি মাথায় এলে চোখে ভাসে ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রটি—একজন নারী। গোলাপি চরিত্রে ববিতা। ছবিটির দ্বিতীয় কিস্তিও তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া আসিয়া, কাচের দেয়াল, বেহুলা, আনোয়ারা, সূর্যদীঘল বাড়ি, ভাত দে ইত্যাদি ছবিতে নারী চরিত্র প্রাধান্য পেয়েছে।
অথচ নিকট অতীতে অগ্নি বাদে এমন একটা ছবির আর উদাহরণ নেই। বাণিজ্যিক ছবির সফল পরিচালক মনতাজুর রহমান আকবর নারী চরিত্রকে কেন্দ্র করে বাঘিনী কন্যা, বস্তির রানী সুরিয়াসহ বেশ কিছু ছবি নির্মাণ করেছিলেন। তিনি বলেন, এখন মূলত প্রযুক্তির দিক থেকে এগিয়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় থেকে ছবি হচ্ছে। এগুলো কাহিনিনির্ভর নয়। তাই নারীকে কেন্দ্র করে বাণিজ্যিক ছবি নির্মাণে চরিত্রটির যে পরিমাণ শ্রম, মেধা ও সময়ের প্রয়োজন, তা দেওয়ার মতো শিল্পীও মিলছে না। তা ছাড়া মাঝে কিছু ছবি ব্যর্থ হয়েছে, তাই নির্মাতারাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
নতুনের কেতন উড়ছে না
চিত্রনায়ক রাজ্জাক তাঁর ৭৫তম জন্মদিনের বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আমাদের শ্রদ্ধেয় পরিচালকেরা আমাকে আর তিন নায়িকা নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন।’ সত্তরের দশকে রাজ্জাক তাঁর বিপরীতে তিনজন নায়িকা পেয়েছেন। এক দশক আগেও মান্না, রিয়াজ, ফেরদৌসেরা নিজের সঙ্গে পর্দা ভাগাভাগি করতে চার-পাঁচজন নায়িকার সহযোগিতা পেয়েছেন। ২০১০ সালের পর চলচ্চিত্র ডিজিটাল যুগে ঢোকার পর নতুন নায়িকা যোগের মিছিল হয়।
শাবনূর, পপি, পূর্ণিমা, অপু বিশ্বাসদের সঙ্গ দিতে মাঠে নামেন জয়া আহসান, মাহী, ববি, বর্ষা, পরীমনি, অমৃতা, ফারাহ রুমা, পিয়া বিপাশা, মৌসুমী হামিদ, নাবিলা, নুসরাত ফারিয়াসহ অনেকেই। কিন্তু এই যুগের শাকিব খান, শুভ, নিরবের বিপরীতে অভিনয়ের জন্য পরিচালকেরা কলকাতার নায়িকাদের দিকেই বেশি ঝুঁকছেন।
নতুন মুখের অভাব নেই। কিন্তু তাঁদের সিংহভাগই দর্শকের মন কাড়তে পারছেন না। স্থায়ী হচ্ছেন না। এমন অনেক নায়িকা আছেন, দু-একটা ছবির পর যাঁদের আর কোনো খবর থাকে না। আশ্রয় হয় ছোট পর্দায়—নাটকে কিংবা পণ্যের বিজ্ঞাপনে। কেউ আবার উপস্থাপনা করছেন।
কারণ কী?
কেন এমন হলো? গোলাপি এখন ট্রেনে, ভাত দের মতো নারীপ্রধান চলচ্চিত্রের পরিচালক আমজাদ হোসেন বলেন, এখন কেউ শিল্পের প্রতি নিবেদিত নন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি নিজের কাজের অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ আনেন। বললেন, তখন কখনো কোনো শিল্পীর কাছে শিডিউল চাইতে হয়নি। সেটে দেরি করে আসার মতো ঘটনা কোনো নায়িকার ক্ষেত্রে কখনো ঘটেনি। তাঁরা অভিনয়কেই ধ্যানজ্ঞান হিসেবে নিতেন। নীতিবোধ, শৃঙ্খলাবোধ ছিল। এখন এসবের খুব অভাব।
চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ বলেন, একসময় জহির রায়হান, কাজী জহির, এহতেশাম, খান আতাউর রহমান, সুভাষ দত্ত, আজিজুর রহমান, আমজাদ হোসেন, চাষী নজরুল প্রমুখের মতো নির্মাতা ছিলেন। তাঁরা কোথায়? তাঁরা নায়িকাদের হাতে-কলমে কাজ শিখিয়ে নায়িকা তৈরি করেছেন। ওই সময়ের নায়িকাদের মধ্যে শেখার আগ্রহও ছিল। এসব নির্মাতাকে ‘শিল্পী তৈরির কারিগর’ও বলা হতো। এখন নায়িকা তৈরির সে রকম নির্মাতাও নেই।
উপমহাদেশের চলচ্চিত্র মূলত নায়ক-নায়িকানির্ভর। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একজন নায়িকা, একজন নায়ক গল্প এগিয়ে নিয়ে যান। এ ক্ষেত্রে বললে অত্যুক্তি হবে না, চলচ্চিত্রকে সফল করতে নায়িকার গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু দিন বদলেছে। চলচ্চিত্র এখন ডিজিটাল দুনিয়ায় ঢুকে গেছে। ব্যবসা না বাড়লেও বাজারের পরিসর বেড়েছে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশেরও সুযোগ এসেছে। একইভাবে প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। এমন বাস্তবতায় নায়িকা বিষয়ে আলাদা করে না ভাবলে সংকটে থাকা চলচ্চিত্র শিল্প আরও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
নায়কের দাপট
নায়িকা তৈরি হওয়া বা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ক্ষেত্রে নায়কের প্রভাব সব সময় ছিল। এমনিতে উপমহাদেশের চলচ্চিত্র নায়কশাসিত। বলিউডেও দিনের পর দিন নায়কই প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশে নায়ক-নায়িকা সমান তালে কাজ করে জুটিপ্রথা চালু ছিল দীর্ঘদিন। নব্বই দশকে সালমান শাহ, মান্না, ওমর সানী, রিয়াজ, ফেরদৌস প্রমুখ নায়ক সব নায়িকার সঙ্গেই কাজ করেছেন। কিন্তু পরে বিভিন্ন সময় নায়ক কেবল নির্দিষ্ট নায়িকাদের সঙ্গেই কাজ করেছেন। নতুন নায়িকা নেওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি জানিয়েছেন, বিধিনিষেধ দিয়েছেন। এটাও নায়িকাদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করে।
নায়িকাদের কথা
একসময়ের জনপ্রিয় নায়িকা রোজিনা বলেন, এখনকার পরিচালক যাঁরা আছেন, তাঁরা শিল্পী তৈরি করতে পারছেন না। আবার শিল্পীও যে নিজে তৈরি হবেন, সেই তাগিদ তাঁদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। কাজের প্রতি তাঁদের নিষ্ঠা, আন্তরিকতার বড় অভাব। সবচেয়ে বড় কথা, এখনকার নায়ক-নায়িকাদের নায়ক-নায়িকা মনে হয় না। তাঁরা নিজেদের ইমেজ সেভাবে তৈরি করতে পারেন না, ধরে রাখতে পারেন না।
আর বর্তমানের নায়িকা মিম বলেন, আগে অনেক ভালো পরিচালকের হাতের ভালো গল্পের ছবি নির্মিত হতো। এটা নিয়মিতভাবেই হতো। গল্পে নায়ক ও নায়িকার সমান গুরুত্ব ছিল। এখন বেশির ভাগ ছবি নায়ককেন্দ্রিক। এখন সেই গল্পও নেই, গল্পে নায়িকার গুরুত্বও নেই। ফলে দর্শকেরা নায়িকাদের আর মনে রাখছে না।
No comments